বুধবার, ৫ মার্চ, ২০১৪

তানিম কবিরের “ওই অর্থে”..একটি স্পষ্টীকৃত ক্রৌঞ্চকথন



বৃষ্টির কবিতা লেখা প্রসঙ্গে

তবে আমি বৃষ্টির কবিতা লিখিবো,
এটা বলতে পারি।
একদিন মানে কোনও একদিন
বৃষ্টিথেমে গেলে মনে হয় যেমন ‘ও আচ্ছা!’
সেইরকম হুট করে টের পাওয়ার অঙ্গভঙ্গিসহকারে
বৃষ্টির কবিতা লেখা দরকার।
যেহেতু ‘এইদেশে বৃষ্টি হয়’-
আর ছাতার মিস্তিরিরা ভোট দিতে যায়;
মেরামত করা কালো ছাতা নিয়ে তাই,
বৃষ্টির কবিতা লিখতে চাই আমিও।



কবি বৃষ্টির কবিতা লিখতে চান, সমস্যা নেই কোনো তবে কোন অর্থে তিনি কবিতা চিত্রিত করবেন তা একটু বুঝতে পারা সময়সাপেক্ষ ব্যপার বৈকি। গুড়ি-গুড়ি ধারার অর্থে নাকি মুষলধারার পরাক্রান্ত-বেগ অর্থে..আসলে কোন অর্থে? শাব্দিক অর্থে নাকি রূপক অর্থে; নাকি দুটোই একইরকম কিছুটা কাছাকাছি “ওই অর্থে”?


কোন অর্থে একটি ক্রৌঞ্চ তার একান্তই একটি সন্ধ্যেকে সন্নিবেশের গাঢ় ছায়ায় অবলোকন করলো? কখনোবা সওয়াড়ী হয়ে ছুটে চললো নির্জন প্রান্তরে; আবিষ্কারের নেশায় উন্মত্ত হয়ে তছনছ করে চললো গহীন শালবন, আত্মজিজ্ঞাসায় ভরপুর হয়ে কোন নির্জন বনছড়ার কোলে গা এলিয়ে দিলো? কোন মাউথঅর্গ্যানের সুরের মায়াজালে আবদ্ধ করলো মাষ্টারবাড়ি স্টেশন কিংবা তার সন্নিকট তা এক রহস্যই বটে! কাব্যকলার রহস্যে মোড়ানো কোনো জার্নালিকায়ই তার স্বরূপ উন্মোচন হতে পারে হয়তো।


‍‍অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৪ ইং সালে প্রকাশিত “তানিম কবির” এর কাব্যগ্রন্থ “ওই অর্থে” বইটি আশ্চর্য একটি কবিতা-ক্ষেত্রের প্রয়াস তুলে ধরে যা সফলতার সাথে একত্রে সমন্বয় ঘটিয়েছে কোনো ক্রৌঞ্চের হাহাকারপূর্ণ একটি জমাটবদ্ধ এলানো জীবনের; যেখানে ঝরাপাতার মতো বিক্ষিপ্ত হয়েছে কবিমনের উপচে ওঠা জারকরস। এই রস পরিপূর্ণভাবে একটি ভিন্নার্থে, কবিভাষার নির্দিষ্ট, কিছু সাজানো গোছানো মূলত কবিমানসের ওই অর্থেই পাঠকদের সিক্ত করে চলে।



“এগেইন

হেমন্ত পুনঃ পুনঃ আসে
রেলের বাঁকের পাশে
আশা পড়ে থাকে তবু
তাহাকে পাবার-
আমি তার না থাকার
ব্যাথাটাকে কেন যেন
টের পেতে চেয়েছি আবার”



যদিও “প্রভাত চৌধুরী” তাঁর পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতার ভূমিকায় বলেছেন “আজকাল অনেকেই এমনভাবে বাংলা কবিতাকে শেষ করেন যাতে বোঝা যায় কবিতাটি অসমাপ্ত” কিন্তু “ওই অর্থে” কবিতাগ্রন্থটিতে তানিম কবিরের অধিকাংশ কবিতাই উল্লেখিত নিয়মটিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে কোনোরূপ যুক্তিফাটল বা লজিক্যাল ক্র্যাক বা লজিক্যাল ক্লেফটের উন্মেষ না ঘটিয়ে পাঠককে সুন্দর সমাপ্তির দিক টেনে নিয়ে পৌছেছেন সুন্দর সমাপ্তিতে। ৩৬ টি কবিতার সমন্বয়ে মলাটবদ্ধ হওয়া বইটিতে কবি খুঁজে ফিরে বেড়িয়েছেন নিজেকে কিংবা তার ছায়াকে।


“ঘুমভষ্ম

তোমার হাতের লেখা নকল করে
অজস্র চিঠি আমি লিখেছি নিজেকে,
লটকন গাছের নিচে বিকেল পুঁতেছে
তার স্নেহধন ছায়া-”



কবিতার বিষয়বস্তু এবং রূপকলার মিলিত সত্তা যখন একসাথে উপস্থাপিত হয় তখনই কবিতার আসল সৌন্দর্য্য উপঢৌকন হয়ে বের হয়ে আসে, করে পাঠকের মনের উপর রেখাপাত। জীবনানন্দ দাশকে উৎসর্গ করা “নিশ্চুপে উড়িতেছে চিল” কবিতায় চিলরূপী কবি উন্মোচন করেছেন তার নির্জন-ভজনের স্তর, একক ভুবনের অক্ষমতা যা ক্ষণিকের তরে পাঠককে কবিভুবনের সাথে একসূত্রে গেঁথে চলে..


“বাড়তি অবকাশে, কর্পুর ঘ্রাণ ভাসে-
ভাঁজ করা জীবন-অভিমুখে।
কোথাও বুকের তিলে
অজ্আত কীট সেজে রই,
আমি বইতে শুরু করেও বইতে পারিনা কেন হাওয়া-
এ জবাব বুকে নিয়ে নিশ্চুপে উড়িতেছে চিল!
সোনালী ডানার চিল।”



একাকীত্বের স্বরূপ আরো তীব্রভাবে ফুঁটে বেড়োয় “মেবি স্কাই” এর লাইনগুলোতে:


আকাশ অতটা উঁচু নাওহতে পারে
এই সংশয়যোগে নদীর কিনারে
বসে আছি এইটুকু বসে থাকা নিয়ে

“আমার যা ভালো লাগে ইনিয়ে বিনিয়ে
বর্ণনা করে শুধু বলে কয়ে যাওয়া
আকাশটা হতে পারে আকাশেরই হাওয়া
ফুলিয়ে রেখেছে কেউ চারিচারি ধারে
আকাশ অতটা উঁচু নাও হতে পারে”



সর্বজনীনতার পাশাপাশি কবি হালকাভাবে স্যাটায়ারের কিছুটা দোলা দিয়েছেন তার “স্বাধীনবাংলা বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেল” কবিতাটিতে-


“এমনই বিজয় দিবস এসেছে ভুবনে যে,
বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেলে বসে থাকা যাচ্ছে প্রায় আনমনে!
বিজয়ের চেতনায় সমুজ্জল মাছেরা
সদরঘাটেই পাড়ছে ফাল
কল্যানপুর হতে, একটি মঙ্গলশোভাযাত্রায় চড়ে
আমরা এসেছি পড়ে এথায় রে হায়!”




কবিতার মুখ্যত চাররকম প্রকরণঃ অলংকার, রূপকল্পনা, ছন্দ এবং ছন্দস্পন্দ এর সরব উপস্থিতি রয়েছে “ওই অর্থে” কাব্যগ্রন্থটিতে। কবিতাগুলোর শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ ও রূপের মাধ্যমে কবি পাঠকের ইণ্দ্রিয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন, আক্রান্ত করিয়েছেন পাঠককে ভাবালুতার ঘেরাটোপে। “রুশাই তারুশ” টাইটেলের কবিতাটির নামকরনটি উল্লেখযোগ্য। কবিতাটি পঠণের মধ্য দিয়ে যে চিত্র সমাবেশের উদ্ভব ঘটে তাতে এর মধ্যস্থিত তীব্র আকুতি ভাললাগার সমন্বয়ে ডালপালা বিস্তার করেঃ



অসুখও আমার,
নিরাময়ও তুই-

শিরাময় সুঁই যেন
বিপুল সিরিঞ্জ যেন
ভ্যাকুয়াম পুশ-

রুশাই তারুশ মম
রুশাই তারুশ!



“যুদ্ধবিমান” কবিতাটির দুয়েক-ছত্র অবলোকন করলে ছন্দের উপস্থিতির প্রমান পাওয়া যায় তবে কবিতার সমগ্রতা বা ঐক্যের কোন ঘাটতি হয়না তাতে:


“হেমিলি আকাশে চাঁদ প্লেনের পাংখা লাগে ধার
আমি এ চাঁদের তলে নখ কাটবার সমাচার
বলেছি লেবুর কাছে, বলেছি এখন থেকে তুমি
আরো বেশী পেশাদার স্মৃতি চারনার সিমফনি
হয়ে ঠোঁটে চুকচুক আফসোস বেদনার ধ্বণি
প্রত্যাহারের দিকে ধাবমান কালচে গোঙানি”



কবিতায় সৌন্দর্যোপলব্ধি বলে একটি ব্যপার থাকে। সে সৌন্দর্য ধরা দিতে পারে কবিতায় বর্ণিত সেন্ট্রাল থিমটিতে, প্রকাশভঙ্গিতে, আনন্দপ্রদান করতে পারার সক্ষমতার বিষয়টিতে কিংবা বোধ্য-দুর্বোধ্যতার কোলাজে। সম্পূর্ণ আনন্দ লাভ করা কিংবা সৌন্দর্যসৃষ্টি যে উদ্দেশ্যেই হোকনা কেন ভাবনার এক রাশ সম্মেলনের ছোঁয়ায় তানিম কবির তার “ওই অর্থে” এর মাধ্যমে হয়ে উঠেন আরো বেশী প্রকাশমান এবং আরো বেশী মূর্ত, কবিতার মাধ্যমে ভেঙ্গে ফেলেন তার চারপাশে সৃষ্টি করা দুর্বোধ্যতার দেয়াল। প্রিয় পাঠক, আসুননা চলে আসুন, কিছুক্ষণের জন্যে ঘুরে আসি কবিতার পাখিঅলারূপী তানিম কবিরের একান্তই নিজস্ব, তরঙ্গায়িত চিত্রপটের অব্যক্ত কথামালার আসর “ওই অর্থে” থেকে-



বাদামের সাঁকো
আমি কেন গেজদাঁত, বাদামি রঙের চোখ প্রত্যাশা করি!
কেন ধরি বাম হাত, অফুরান গন্ধের পুষ্পশুমারি-

পরাণ পড়েছে,
উঠে দাঁড়াতে কি পারবে না আর?
পত্রপোড়ানো আলো; সে আলোয় ভেসে ওঠে তার

বাতাবি লেবুর সার-সংক্ষেপে
নড়ে ওঠে তার-তাকাবার ভঙ্গিটি!
আমি কবে ভুলে গেছি হাঁটুজল জলপাই তবু

জলের ধমক আসে
বলে মনা ডুবে যাও, ডুবে-
ডুবের ভেতরে বসে, হাঁটুজলে লালরঙ শাপলা ফোটাবে।

আমি খাঁচার ব্যবসা করি
পাখি সবকরেরব খাঁচার ভেতরে-
আমিপাখিঅলা, ডানা ভাঙি-উড়তে বলিনি তাকে,

চুপচাপ বসে
থাকতে বলেছি শুধু থাকো-
উড়ে টুরে চলে গেছে গেজদাঁত- বাদামের সাঁকো।







***************
এক নজরেঃ
বইঃ ওই অর্থে
লেখকঃ তানিম কবির
ধরনঃ কাব্যগ্রন্থ
প্রচ্ছদঃ খেয়া মেজবা
প্রকাশকঃ শুদ্ধস্বর
প্রথম প্রকাশঃ অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১৪
মোট পৃষ্ঠাঃ ৪৮
মূল্যঃ ৯০.০০ টাকা



**************
আশরাফুল কবীর
২২ শে ফাল্গুন, ১৪২০
রামপুরা, ঢাকা।