শুক্রবার, ১৭ আগস্ট, ২০১২

আনন্দ বেদনায় অম্লান: ঈদ কথকথা




ছোটবেলা




ক্লাস ফাইভ ছেড়ে সবে মাত্র সিক্সে ভর্তি হব ঠিক এ সময়টিতে বাবা বদলি হলেন শহর থেকে, বলা যায় একদম অজপাড়াগাঁয়ে। আমার বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে আমাদের কদিন পরপরই এ ধরনের বদলি আতঙ্কে থাকতে হতো। আজ এ স্থানে তো কাল বাদে পরশু একদম নূতন কোন স্থানে। 

একেতো নূতন স্থান তার উপর নূতন নূতন মানুষদের সাথে পরিচয় আমাদের বিরক্তি উৎপাদন করতো কিন্তু কিচ্ছু করার উপায় ছিলনা, পরিচিত উপরের কোন আত্বীয় স্বজন না থাকাতে ছিলনা বদলি ক্যানসেল করার কোন ধরনের কোন উপায়। 

যদিওবা কোন উপায় ছিল কিন্তু তা ছিল আমার বাবার সাধ্যের অনেক বাইরে, অগত্যা যাওয়া ছাড়া কোন রাস্তা খোলা থাকতনা।

শহরের উপকন্ঠ ছেড়ে চলে আসতে হলো গাছগাছালিতে ঘেরা হাওরবেস্টিত অঞ্চলে, সবচেয়ে ভাল লেগেছিল যে জিনিসটি তা হল নূতন বাসার অদূরেই ছিল বয়ে যাওয়া একটি নদী। অফিস কোয়ার্টার হওয়ায় বিশাল একটি বাসা প্রাপ্তি ছিল আমাদের অন্য ধরনের আরেকটি আনন্দের উপলক্ষ। আরো একটি জিনিস দ্রূত আবিষ্কার করে ফেললাম তা হল কিছুক্ষণ পরপর নদী দিয়ে চলে যাওয়া ট্রলারের দ্রিম দ্রিম শব্দ বাসা থেকে বসেই শোনা যায়।







নদীর কোলে





ছোটবেলায় মাঝে মাঝে লঞ্চে চড়ে ঢাকা আসার সময় নদী দর্শন হতো। বইয়ের নদী আর বাস্তবের নদী মিলতনা কোনভাবেই, বাস্তবের নদীটিকে মনে হতো বিশাল কোন কিছু যার বুক চিড়ে অনবরত চলছে বিশাল বিশাল স্টিমার। আমার নিকট সবগুলো লঞ্চকেই এক একটি স্টিমার মনে হতো। ভুলটা বাবা ভাঙ্গিয়ে দিতেন সময় সুযোগ মতোন। 

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম আমরা তারপর মুন্সীগঞ্জ থেকে লঞ্চে করে সোজা এসে পৌছাতাম ঢাকায়, এসে থাকতাম খালাম্মার বাসায় একরাত এবং ঠিক তার পরদিনই ঢাকা থেকে সিলেট আমার দাদাবাড়ী, অবশ্য আমাদের দেশের বাড়ি হচ্ছে হবিগঞ্জ কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করলে সোজা বলতাম সিলেট। 

ঈদ উপলক্ষে সিলেট যাবার কালে ভৈরব সেতুতে ফেরি পারাপার ছিল আরেকটি আনন্দের উপলক্ষ। লোহা লক্করের তৈরী বিশাল ব্রিজেটির নীচ দিয়ে ফেরি যখন মেঘনা নদী পার হতো তখন বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে কেবল অবাকই হতাম আর কিছুক্ষণ পর পর লাল রঙের ঠান্ডা মিরিন্ডার বোতলে চুমুক দিতাম। 

যদি কোনভাবে দেখা যেত ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন ছুটছে তাহলে তো কোন কথাই নেই, সবাই একযোগে চিৎকার করে ওঠতাম “ট্রেন, ট্রেন, ট্রেন - ঐ দেখ ট্রেন যায়” 

আমাদের বাসায় থাকা একই ক্লাসে পড়ুয়া আমার খালাত ভাই আমার সাথে ট্রেন দেখার প্রতিযোগীতা শুরু করতো, বেশীর ভাগ সময়ই ট্রেন যে পাশটি দিয়ে চলে যেতো সে খুঁজতো ঠিক তার উল্টো দিক দিয়ে। বাবা ওর দিকে তাকাত আর হেসে হেসে বলতো “আরে গাধা! ঐ দিকে না, উল্টা দিকে” 

খুব ভাল লাগত নদীর মাঝখানে নোঙ্গর করে থাকা বিশাল বিশাল লঞ্চগুলোকে দেখতে। অবশ্য বাবার ভাষায় “ঐগুলো লঞ্চ নয়, ঐগুলো হল স্টিমার”

আমাদের অফিস কোয়ার্টারের ডানদিকে ছিল গ্রামটির একমাত্র স্কুল, আরেকটু ডানপাশ দিয়ে বাসার পেছন দিয়ে ছিল গ্রামে যাবার পায়ে হাঁটা পথ। খুব ঘন গাছপালায় পরিপূর্ণ হওয়ায় বনবিড়ালদের দেখা পাওয়া ছিল নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার স্যাপার। আমার আম্মা অবশ্য মাঝে মাঝেই খুব বিরক্ত হয়ে বলে ওঠতেন “কোথায় এসে পড়লামরে বাবা!”

অফিসের সম্মুখে বিশাল দুয়েকটি রেইন-ট্রি গাছ ছিল, আর ছিল তার আশে পাশে গোটা কয়েক চা-স্টলের দোকান আর পরিষ্কার করে রাখা কিছু জায়গা যেখানে সপ্তাহের প্রতি শনিবার ও বুধবার হাট জমে ওঠত। 

নূতন স্থানে এসে আবারো নদী দর্শন হলো আমাদের সকলের। তবে এবারের নদীটি আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাড়াল। ভর বর্ষায় এর রূপ হয় একরকম আর শুকনো মৌসুমে হয় আরেক রকম। 

আমি অবশ্য নদীটিকে নদী বলে মেনে নিতে পারতামনা, বারবার শুধু মনে হতো “আরে ধূর! এইটা কোন নদী হইলো, নদী এত্তো ছোট হয় নাকি” মনে মনে ভাবতাম এখানে বোধ হয় বেশী দিন থাকা হবেনা।

অবশ্য বাস্তব ঘটনা ঠিক তার উল্টো হয়েছিল। খুব হলফ করে বলা যায় এই ছোট ধলাই নদীর তীরেই আমাদের পরিবারকে কাটাতে হয় প্রায় বিশটি বছর। আমরা ছেড়ে চলে আসতে চাইলেও নদীটি আমাদেরকে ছাড়েনি।

বাবা জেলার ভেতরেই আরো বেশ কয়েকটি জায়গায় বদলি হয়েছিলেন তবে আমরা আমাদের বাসা আর সেখান থেকে বদলিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়নি। ট্রলারের অদ্ভুত ‘দ্রিম’ ‘দ্রিম’ ছন্দে আমরা সবাই মায়াচ্ছন্ন ছিলাম দীর্ঘদিন।

বেশ কিছুদিন পরে জানতে পারলাম আমাদের বাসার পাশের নদীটির নাম ‘ধলাই’ নদী, ধলাই বললেই আমার জানাশোনা ‘ধলেশ্বরী’ নদীর নাম ভেসে ওঠতো। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের এলাকায় অনেক পরিচিত বন্ধু গড়ে ওঠলো।

আমার সাথে পরিচিত হলো আশে পাশের বেশ কিছু গ্রামের একই ক্লাসের কয়েকজন ছেলের। এদের মধ্য অন্যতম দুয়েকজনের বাড়ি ছিল নদীর ওপাশটায়।

নদীর কিনারে দাড়ালে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে নদীর ওপাশটায় দেখা যেত মানিকদের বাড়িটা। তখনো যাওয়া হয়নি ওদের বাড়িতে, মানিক আমাকে নদীর তীরে দাড় করিয়ে চেনাতে চেষ্টা করতো ওদের বাড়ি। বলতো 

“ঐ দেখো টিনের ঘরগুলো উঁচু উঁচু, আর ঐ লম্বা লম্বা নারিকেল গাছগুলো, ঐটাই আমাদের বাড়ি” 

আমি অবশ্য বাড়ি না চিনতে পেরে অনেকগুলো লম্বা লম্বা নারিকেল গাছ দেখতাম এদিক সেদিক, বোঝার চেষ্টা করতাম ওদের বাড়ির অবস্থান আর ওর কথায় মাথা ঝাঁকাতাম এই বলে, “হুমম, চিনতে পারছি” 


বেশ কয়েকবছর নূতন স্থানটিতে ঈদ করা হয়নি তাই বাবা ঠিক করলেন সেবার সেখানেই ঈদ করবেন, সিলেট যাওয়া হবেনা। বাবা বললেন 

“এবার আমরা এখানেই ঈদ করবো, সিলেট যাওয়াটা অনেক ঝামেলার, কোরবানীর ঈদে সবাই একসাথে বাড়ি যাব” 






যাত্রাপালা




অপরিচিত হওয়ায় নূতন জায়গায় আমাদের ঈদ তেমন একটা আনন্দদায়ক হলোনা। বিকেলে মানিক আসলো এবং আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য, বললো: 

“আন্টি রাসেল রাতে আমাদের বাড়িতে থাকবে আমার সাথে, আজকে আমাদের বাড়িতে রাতে গান আছে” 

ভরা বর্ষাকাল বলে ওদের বাড়িতে ট্রলারে করে যেতে হবে। আমার আম্মা একবাক্যে না করে দিলেন কিন্তু আমার জোর দেখে শেষ পর্যন্ত যেতে দিলেন বললেন

“ঠিক আছে যাও, তবে সাথে করে করিমকে নিয়ে যাও” বলে রাখা ভাল করিম হলো আমার খালাতো ভাই। 

গান বলতে গ্রামে গঞ্জে অনুষ্ঠিত হওয়া যাত্রা পালাকে বোঝায় সেটা আমি রাতের বেলায় টের পেলাম, তবে যাত্রাপালা ঠিক সেটাকেই বোঝায় তা পরিষ্কার হয় আরো বেশ কয়েক বছর পরে। আমার এর পূর্বে যাত্রাপালা দেখার কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা। মানিক আমাকে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খাওয়াল এবং তারপরেই বললো “রাসেল, চলো, চলো, তাড়াতাড়ি চলো, জায়গা নিতে হইবো”।

কোথায় যাবো আর কোথায় জায়গা নেবো আমি ঠিক বুঝতে পারছিলামনা তবে মানিকের ভাব দেখে বুঝতে পারলাম কিছু একটা করতে হবে তাড়াতাড়ি, তাই দ্রূত করতে লাগলাম। খাওয়ার পর্ব শেষ করে কিছুদূরে আরেকটি বাড়িতে গিয়ে উঠলাম, দেখলাম বেশ বড় ধরনের একটি স্টেজ বানানো হয়েছে। 

স্টেজের চার কোনায় চারটি বিশাল হ্যাজাক লাইট জ্বলছে, লাইটের আলোতে বেশ অনেকটা দূর পর্যন্ত আলোকিত হয়ে আছে। স্টেজ ঘিরে আছে অনেক লোকজন, মেয়েদের জন্য আলাদা একটি অংশ রাখা হয়েছে, সেখানে অনেক দূরের গ্রাম থেকেও মহিলারা ছেলেমেয়েসহ এসেছে গান দেখার জন্য।

মানিক খুব দ্রূত কিছু ধানের খড় নিয়ে আসলো এবং মঞ্চের একদম নিকটে গিয়ে খড় দিয়ে দুটি আসন তৈরী করে ফেললো, ওর চোখে মুখে এমন একটি ভাব খেলা করছিলো যেনো কোন কিছুই সে মিস করতে চায়না আর গানের সবকিছুই সে উপভোগ করতে চায়।

আমরা যে পাশটিতে বসেছিলাম ঠিক তার উল্টো দিকে তিনজন বয়স্ক লোক তিনটি বড় ধরনের পিতলের অর্গান নিয়ে বসেছিল। হঠাৎ খেয়াল করলাম তিনজনই অর্গানগুলো বাজাতে শুরু করলো, বিকট বাজনা আসলো, সাথে সাথে মঞ্চের ভেতর কয়েকজন ছেলে এসে প্রবেশ করলো। 


কারো বয়স আন্দাজ করা যাচ্ছিলনা কারন প্রত্যেকের মুখ অদ্ভুত রকমের সাদা রঙ দিয়ে আচ্ছন্ন করা ছিল। বুঝতে পারছিলামনা এরকম বিরক্তিকরভাবে কেন মুখে রঙ মেখে সঙ সেজে এসেছে, মানিকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে হারিয়ে গেছে গানের ভেতর।

মঞ্চের অপর পাশে আরেকজন লোককে দেখলাম একটি খাতা মতোন কি যেনো নিয়ে বসে আছে, লোকটিকে দেখামাত্রই চিনতে পারলাম। এতো সেই লোক যে কিনা আমাদের বাসার সামনে যে সপ্তাহের হাটে বসে দোকান নিয়ে, খুব অদ্ভুত লাগলো তখন এই ভেবে যে ওই লোক এখানে কি করছে।

মঞ্চ থেকে আসা গানের চিৎকারে সম্বিত ফিরে আসলো, শুনলাম লোকগুলো গাইছে 

“এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা, সুরমা নদীর তটে” 

গান শেষ না হতেই বাঁশি হারমোনিয়ামের একত্রিত শব্দে পালা শুরু হলো যা মানিকের ভাষায় ছিল গান। পালার নাম ছিল “কাজল রেখা” নাটকের কাজল সেজে অভিনয় করেছিলেন আমার এক ক্লাসমেটের বড় ভাই যিনি কিনা উনার ঘাড়ের পেছনে পড়ে থাকা বিশাল বিশাল লম্বা চুলগুলোকে মাঝে মাঝে নেড়ে চেড়ে দিয়ে খুব ভাব নিতেন।

কাজলকে দেখে খুবই অবাক হলাম, সবচেয়ে অবাক হলাম রেখাকে দেখে। তার মুখেও ছিল যথারীতি সাদা রঙ, কিছুক্ষণ দেখেই বিরক্ত লাগল। সেই বয়স্ক লোকটিকে দেখলাম বেশ গম্ভীরভাবে আস্তে আস্তে কি বলে দিচ্ছেন আর তার কথাগুলোই মঞ্চের অভিনেতারা আওড়ে যাচ্ছে। উনাকে তখন ঐ অবস্থায় দেখে বেশ একজন গুরুগম্ভীর লোক বলেই মনে হলো।

আমি কিছুক্ষণ নাটক দেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম। জেগে ওঠলাম মানিকের গুতো খেয়ে, বললো:

“এই রাসেল, ওঠ, ওঠ, ওঠ দ্যাখ, দ্যাখ রেখা আইছে” 

বলাই বাহুল্য পালার নায়িকা রেখা মঞ্চে এসেছে যাত্রার ঢঙ্গে, এসেই সংলাপ বলা শুরু করে দিয়েছে। আমি আবারো ঘুমিয়ে গেলাম।

পরদিন আমি বাসায় এসে বিস্তর হাসাহাসির খোরাক হলাম। জানতে পালাম রেখা চরিত্রে কোন মেয়ে অভিনয় করেনি, গ্রামের একটি ছেলে মেয়ে সেজে অভিনয় করেছে, আমি খবরটি শুনে বিস্মিত হলাম, আমি কিনা সামনে বসেও এ রহস্যটি উদঘাটন করতে পারিনি। আগের রাতের যাত্রাপালা অবশ্য সুন্দরভাবে সম্পূর্ন শেষ হতে পারেনি, শেষ দিকে বৃষ্টি এসে রেখা পালার যবনিকা ঘটায়।





ট্রলার





ট্রলার যখন ছাড়লো কিছুক্ষণের মধ্যেই আমদের ট্রলার নদীর মাঝামাঝি এসে পড়লো। আমি ট্রলারের উপরে বসবো বলে সামনে দাড়ালাম, দূর থেকে আমাদের বাসার সামনের বিশাল বিশাল রেইন-ট্রি গাছগুলোকে অনেক ছোট ছোট দেখাতে থাকলো। 

এই প্রথম গ্রামের উল্টো দিক থেকে গ্রামের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য দেখতে পারলাম, বুঝলাম গ্রামের চারপাশ থেকে হাওর আর নদী যৌথভাবে কিভাবে গ্রামটিকে চেপে ধরেছে। মনে হলো এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।

আচমকা মনে হলো আমি যে প্যান্টটি পড়ে মানিকদের বাড়িতে যাচ্ছি সেটার নীচ দিক দিয়ে অনেকটা জায়গায় আগেরদিন ছিড়ে গিয়েছিল, পড়ার সময় খেয়াল ছিলনা তাই এ মুহূর্তে মনে পড়াতে চরম অস্বস্থিকর অবস্থাতে পড়লাম, এখন আর বাসায় ফেরার ও কোন উপায় নেই। 

ট্রলারের উপর উঠেই মানিক আমাকে ডাকতে শুরু করলো “এই রাসেল, এইখানে চইল্যা আয়, দারুন বাতাস লাগতাছে” আমি না শোনার ভান করে অন্যদিকে পাশ ফিরে দাড়ালাম। মাথায় শুধু ঘুরতে থাকলো কোন ভাবেই বসা যাবেনা, কারন বসতে গেলেই সব ফাঁস হয়ে যাবে।

মানিকদের গ্রামে ইলেকট্রিসিটি তখনো পৌছায়নি, তাই ওদের গ্রামে চতুর্দিকে মনে হল কুপি বাতির রাজ্য, হ্যারিকেনের রাজ্য। শহরে থাকতে আমরা সবাই ঈদের নামাজ পড়ে এসে বড়দেরকে সালাম করতাম কিন্তু এখানে দেখলাম সবাই সন্ধ্যের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে সালাম করছে। 

আমি মানিকদের বাড়িতে ঢোকার পর দেখলাম মানিকের আম্মা সহ বেশ কয়েকজন মহিলা অন্ধকারে একসাথে দাড়িয়ে আছে। মানিক বললো আমার আম্মা, আমি আর দেরী না করে মানিকের আম্মাকে সালাম করে ফেললাম, পাশে দেখলাম আরো কয়েকজন বয়োজেষ্ঠ দাড়িয়ে রয়েছেন।

আমি দেরী না করে তাদেরকেও সালাম করলাম একটানে, অত:পর শেষ পা জোড়াকে সালাম করে শেষ করতে পারলামনা ঠিক তার সাথে সাথেই পা জোড়া লাফ দিয়ে একপাশে সরে গেল, উঠে দাড়িয়ে দেখলাম আমার থেকে বয়সে ছোট একটি শাড়ি পড়া মেয়ে লাফ দিয়ে সরে গিয়েছে, আমি বোকার মতোন বুঝতে না পেরে তাকেও সালাম করে ফেলেছি। 

অত:পর আমাকে নিয়ে শুরু হলো তারস্বরে হাসাহাসি, মানিকের দুইগাল জুড়ে উপচে পড়া হাসি ছিল দেখার বিষয়, মহিলাদের মধ্যে কথা বার্তা চলছিল ঘটনাটি নিয়ে, একটা কথা অন্ধকারে ঠিকই এসে কানে বেজেছিল “এই পোলাডা এত্তো বেকুব ক্যান?” 

হাইস্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ঢাকা চলে আসি। পার হয়ে যায় বেশ কিছু বছর অবশ্য আমাদের পরিবার তখনো সেই গ্রাম ছাড়েনি, ছয় সাত বছর পর আবারো কোন এক ঈদের ছুটিতে মানিকদের বাড়ি গেলাম। 

বিকেলের মানিকদের বাড়ির উঠোনে বসেছিলাম। হঠাৎ মানিক আমাকে পেটে আবারো গুতো দিয়ে বললো “দেখতো রাসেল, ওকে চিনতে পারিস কিনা?” 

আমি বেশ কিছু দূরে দাড়িয়ে খাকা একটি মহিলাকে দেখলাম কোলে বাচ্চা নিয়ে দাড়িয়ে আছে, পেছনে আরেকটি। আমি মানিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কি?” আমার বন্ধু মানিক হোসেন আমার দিকে তাকিয়ে আবারো বললো 

“কিরে চিনোস নাই, এইটা সেই মাইয়া, যারে তুই সালাম করছিলি” 

আমি দ্বিতীয় বার তাকানোর সাহস না করে অন্য কথা দিয়ে মানিককে ভুলিয়ে দিলাম।কানে বাজতে থাকলো ট্রলারের পুরনো শব্দ।


................................................................................................................................
পুনশ্চ: এবারের ঈদে ঢাকা ছাড়া হচ্ছেনা, বুঝতে পারছি আরেকটি নিরানন্দ ঈদের উপলক্ষ হবে এটি। বহুদিন হয়েছে সে জলের রাজ্য ছেড়ে ঢাকা চলে এসেছি কিন্তু ঘুমোলে এখনো শুনতে পাই সেই একই সুরে আসা ট্রলারের ইঞ্জিনের ধ্বণি, সুর দিয়ে চলে যাচ্ছে ‘দ্রিম দ্রিম, দ্রিম দ্রিম, দ্রিম, দ্রিম, দ্রিম’




[প্রিয় বন্ধুদেরকে জানাচ্ছি 'ঈদ মোবারক', ভাল থাকুন সকলে]



**********
২রা ভাদ্র ১৪১৯
মতিঝিল, ঢাকা।